*ড. মুহাম্মদ নুর হোসাইন*
সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, চবি।
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদীমাতৃকতা বাংলাদেশকে অনেক সুবিধা দিচ্ছে। এর কারণে অনেক অসুবিধারও সম্মুখীন হতে হচ্ছে। বিজ্ঞানীদের মতে, মানবসৃষ্ট কারণে জলবায়ুতে যে পরিবর্তন এসেছে, তাতে প্রকৃতি বিরূপভাবাপন্ন আচরণ করছে। ফলে বন্যা, খরা, উষ্ণতা মাত্রারিক্ত হারে বাড়ছে। সাধারণত অতিরিক্ত বর্ষণের কারণে বাংলাদেশে বন্যা হয়। ভাটির দেশ হওয়াতে উজানের পানিতেও বন্যার সৃষ্টি হয়। প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারতের কয়েকটি প্রদেশের জলপ্রবাহ বাংলাদেশের দিকে গড়ায়। ফলে ভারতে ভারী বৃষ্টি হলে বাংলাদেশের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষতঃ যখন ভারতের বাঁধ খুলে দেওয়া হয় তখন বন্যার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। ভারত বাংলাদেশে প্রবেশকারী ৫৪টি নদীর মধ্যে ৫১টিতে বাঁধ নির্মাণ করেছে। তম্মধ্যে ফারাক্কা, টিপাইমুখ, ডুম্বুর, তিস্তা বাঁধ বাংলাদেশের জন্য খুবই বিপজ্জনক।
গত ২২ আগষ্ট ফেনী সহ বাংলাদেশের ডজন খানেক জেলা পানিতে তলিয়ে গেছে। এর মূল কারণ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে ভারী বর্ষণের ফলে ধলাই জেলায় গোমতী নদীর ডুম্বর বাঁধের গেট খুলে দেওয়া। ভারত সরকার নিজেদের স্বার্থে প্রকৃতির বিপরীতে বাঁধ দিয়েছে। নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় বাঁধ খুলে দেবে- এটাই স্বাভাবিক। তবে অভিযোগ উঠেছে যে, এবার বাঁধ খুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁরা বাংলাদেশকে কোনো আগাম সতর্কবার্তা দেননি। বৈদ্যতিক গোলযোগের কারণে সেটি সম্ভব হয়নি বলে তাঁরা ব্যাখ্যা দিলেও সেটি বাংলাদেশের জনগণের নিকট গ্রহণযোগ্য হয়নি। যা-হোক, আকষ্মিক বন্যায় জান-মালের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বেশি। এই পর্যন্ত ৫২জন মারা গেছেন এবং ৫৫ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ১৩ কি.মি রেল পথ লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। এতে শুধু রেলের ক্ষতি হয়েছে ছয় কোটি টাকা (দৈনিক পূর্বকোণ, ৩০ আগষ্ট, ২০২৪)। প্রায় ১২টি জেলার সড়ক ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। ঘরবাড়ি, সহায়-সম্পদ হারিয়ে লাখ লাখ মানুষ পথে নেমেছেন। ফেনী সহ বৃহত্তর নোয়াখালী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের উত্তর এলাকার মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেশি হওয়ার কারণ যেটাই হোক না কেন, বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি আমাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে আছে। এগুলো মোকাবেলা করেই বছর বছর ধরে আমরা বেঁচে আছি। তবে এর মাঝেও সুখের বিষয় হলো দলমত নির্বিশেষে সবাই যার যার অবস্থান থেকে বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বেসামরিক লোকজনও জীবন বাজি রেখে উদ্ধারকাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। জনগণের স্বতঃস্ফুর্ত ও আন্তরিক অংশগ্রহণ খুবই আশাব্যাঞ্জক। সারা দেশের সর্বশ্রেণি-পেশার মানুষ যেভাবে উদ্ধারকাজ ও ত্রাণতৎপরতা চালাচ্ছেন, তা অবিস্মরণীয়। এর কারণ একক রাজনৈতিক সরকারের অনুপস্থিতি বলে অনেকের মত হলেও মূল বিষয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খুব দ্রুত সময়ে সচিত্র খবর মানুষের কাছে পোঁছে যাওয়া এবং ভয়াবহ অবস্থা উপলব্ধি করার সুযোগ পাওয়া। বাঙ্গালির মায়া-মমতা ও পরহিতৈষী মনোভাব তো আছেই।
পানির স্রোতের বিপরীতে উদ্ধারকাজ ছিল খুবই কঠিন। প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে নৌ-সেনাবাহিনীও উদ্ধারতৎতপরতা চালাতে হিমশিম খাচ্ছিল। হেলিকপ্টার নিয়ে উদ্ধারকাজে নামতেও যথেষ্ট সময় লেগেছে। জনপ্রতিনিধি ও জনপ্রশাসনের অনুপস্থিতির কারণেও উদ্ধারকাজ কিছুটা অপরিকল্পিত ও বিশৃঙ্খলপূর্ণ হয়েছে বলা যায়। তবুও যুবশ্রেণি সহ সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণ দেশের মানুষকে আশান্বিত করেছে। প্রমাণিত হয়েছে যে, মানবতা এখনো একেবারে হারিয়ে যায়নি। ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিক ভাবে উদ্ধারকাজ ও ত্রাণতৎপরতা চলে আসছে। দেশের প্রায় সর্বত্র সংগ্রহ হয়েছে অনুদান। স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে যার যার অবস্থান থেকে সবাই অংশগ্রহণ করছেন। চট্টগ্রামের পাড়ামহল্লা, হাটবাজার, ধর্মীয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনুদান সংগ্রহ করা হয়েছে। উদ্ধারকাজের জন্য নৌকা, বোট, স্টিমার ইত্যাদি নিয়ে যেতে হয়েছে ট্রাকে করে। আকষ্মিকতার কারণে পরিকল্পিত ভাবে কাজ করা সম্ভব হয়নি। ফলে উদ্ধারকাজ ও ত্রাণতৎপরতায় বিশৃঙ্খলা দেখা গেছে। অনভিজ্ঞতার কারণে উদ্ধারকারী ও ত্রাণ বিতরণকারীদেরকেও বিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছে। মানুষের আবেগকে পুঁজি করে অনেকেই সংগৃহীত অনুদান পকেটস্থ করেছে। ত্রাণের মাল লুট হয়েছে মর্মে খবর এসেছে। ত্রাণের টাকা ও মালের ঢের অপচয়ও হয়েছে। উদ্ধারকারীদের বাহনের ভিড়ে সড়কের যানজটের কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও আশেপাশের যাত্রীদেরকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। প্রয়োজনীয় উপকরণ ছাড়া উদ্ধারকাজ করতে গিয়ে কেউ কেউ মারাও পড়েছেন। মূলতঃ প্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ ছাড়া এই জাতীয় দুর্যোগ মোকাবেলা করা ঝুঁকিপূর্ণ। “সেফটি ফাস্ট” নীতিতেই কাজ করতে হয় এমন দুর্যোগে; যার যার মত করে কাজ করার সুযোগ নেই। অপ্রয়োজনীয় মানুষের গমনাগমনও উদ্ধারকাজ ও ত্রাণতৎপরতা ব্যাহত করছে। ছবি তুলার প্রতিযোগিতার কারণে সেবাকাজের পবিত্রতা নষ্ট হয়েছে; সেবাকাজও ব্যাহত হয়েছে। উৎসুক জনতার ভিড়ে ত্রাণকার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে মর্মে খবর প্রচার হয়েছে। ত্রাণবিতরণে বৈষম্য ও বিশৃঙ্খলা পরিলক্ষিত হচ্ছে। রাস্তার দ্বারের মানুষেরা যখন বার বার পাচ্ছেন তখন অপেক্ষাকৃত দূরে অবস্থানকারীদের ভাগ্যে কিছুই জুটছে না। কেউ কেউ ত্রাণবাণিজ্যও করছে। তাই ত্রাণতৎপরতা আপাতত সর্বজনীন হলেও এর বণ্টন পদ্ধতি কেন্দ্রিয়করণ আবশ্যক। পরিকল্পিত দান ও বৈষম্যহীন বণ্টনের ব্যবস্থা করলে ফলাফল আরো বেশি আসবে। এমন দুর্যোগে উদ্ধারকাজ করতে হবে নৌ-সেনাবাহিনীকে। তবে তাঁদের নেতৃত্বে বেসামরিক দক্ষ লোকেরাও অংশগ্রহণ করতে পারেন। ত্রাণবিতরণের জন্য এলাকা ভিত্তিক সেনাক্যাম্প করে সাধারণ জনগণের ত্রাণ জমা নেওয়া এবং তালিকা করে বৈষম্যহীন ভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের নিকট পৌঁছানো দরকার যেভাবে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ক্ষেত্রে হয়েছিল। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য টাকা বা ত্রাণসমাগ্রীর রশিদ দিতে পারেন ক্যাম্পর দায়িত্বশীলরা। আত্মতৃপ্তির জন্য বা প্রমাণের জন্য সংশ্লিষ্টদের সাথে ত্রাণপ্রদানের ছবিও তুলা যায়। মূলতঃ ব্যক্তিগত ভাবে ত্রাণবিতরণের চেয়ে বিশ্বস্ত সংস্থা-সমিতির মাধ্যমে বিতরণ করা অধিক ফলদায়ক। সরকারি তহবিলে অনুদান দেওয়া আরো নিরাপদ। অনুদানের অপচয় ঠেকাতে অতিরিক্ত মানুষের গমনাগমন বন্ধ করা জরুরি। এতে ক্ষতিগ্রস্তদের দুর্ভোগ বাড়ছে। অন্যদের স্বভাবিক চলাচল ও কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
এখন উদ্ধার কাজ শেষ। ত্রাণ, চিকিৎসা ও পুনর্বাসন সেবা অব্যাহত রাখতে হবে। প্রথম পর্যায়ে অনেকেই আবেগ নিয়ে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ালেও এখন ধীরে ধীরে আবেগে ভাটা পড়তে শুরু করেছে। কিন্তু যাদের তিলে তিলে গড়ে উঠা বসতবাড়ী মিমিষে শেষ হয়ে গেছে তাদের মাথা গোছানোর ব্যবস্থা করা জরুরি। বন্যা উত্তর বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। তাই সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে যথাযথ ব্যক্তিবর্গ ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে চিকিৎসা ক্যাম্প করা প্রয়োজন। চাষীদের জন্য কৃষিউপকরণ ও বীজ দরকার। খামারি, দোকানি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদেরকে সরকারি ভাবে সূদমুক্ত ঋণ দেওয়া উচিৎ। অন্যথায় ক্ষতিগ্রস্তরা ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন না। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তরা আবারো স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাক। মানবতার জয় হোক। সেবাকর্মীরা দীর্ঘজীবী হোন।