অভি পাল
মিয়ানমারে দীর্ঘদিন ধরে চলমান গৃহযুদ্ধ নতুন এক সংকটের দিকে যাচ্ছে, যেখানে রোহিঙ্গা যুবকরাও জড়িয়ে পড়ছেন অস্ত্রের রাজনীতিতে। সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো নিজেদের স্বার্থে তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধে নামাচ্ছে। ফলে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের তরুণরা এক কঠিন দোটানার মধ্যে পড়েছে—যেখানে একদিকে নিপীড়ন, অন্যদিকে অস্ত্র হাতে লড়াই করার বাস্তবতা।
গোপন সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে একটি অংশ মাতৃভূমি মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে এই প্রত্যাবর্তন শান্তিপূর্ণ নয়, বরং সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে সশস্ত্রভাবে ফেরার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। মিয়ানমারের জঙ্গলে গোপনে গড়ে ওঠা প্রশিক্ষণ শিবিরগুলোতে তারা অস্ত্র চালনা, গেরিলা যুদ্ধ কৌশল ও শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির নানা কার্যক্রম চালাচ্ছে। প্রতিনিয়ত স্থান পরিবর্তনের মাধ্যমে তারা প্রশিক্ষণ শিবিরগুলোর অবস্থান গোপন রাখছে, যাতে কোনো পক্ষ তাদের গতিবিধি বুঝতে না পারে।
এক রোহিঙ্গা যুবকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের মূল লক্ষ্য জান্তা বাহিনীর দখল থেকে নিজ ভূমি পুনরুদ্ধার করা। আগে শুধুমাত্র জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পরিকল্পনা থাকলেও, বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (AA) বিরুদ্ধেও অস্ত্র ধরতে প্রস্তুত। কারণ মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মি—উভয় পক্ষই রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করছে এবং নিজেদের স্বার্থে বলি দিচ্ছে। এই বাস্তবতা রোহিঙ্গাদের বাধ্য করেছে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, রোহিঙ্গাদের এই সামরিক প্রস্তুতি মিয়ানমারের ভবিষ্যৎ পরিস্থিতিকে আরও অস্থির করে তুলবে। দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রহীন থাকা এই জনগোষ্ঠীর জন্য অস্ত্র হাতে নেওয়া এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করছে, যা শুধু মিয়ানমার নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তার জন্য নতুন উদ্বেগ সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে, এই সংকট যদি সীমান্ত অতিক্রম করে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে আঞ্চলিক অস্থিরতা আরও বেড়ে যেতে পারে।
রোহিঙ্গারা দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর অত্যাচার, গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার। ২০১৭ সালে চালানো গণহত্যার পর লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই সংকট সমাধানে তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারেনি। ফলে বহু বছর ধরে শরণার্থী শিবিরে বন্দি জীবন কাটানো রোহিঙ্গা যুবকদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ জমেছে। তাদের মধ্যে অনেকে মনে করছেন, কূটনৈতিক উপায়ে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়, তাই অস্ত্র হাতে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।
গোপন সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমারের দুর্গম পাহাড় ও জঙ্গলে এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। নিরাপত্তা বাহিনীর চোখ এড়াতে প্রশিক্ষণ শিবিরগুলোকে বারবার স্থানান্তর করা হচ্ছে। শিবিরগুলোতে সামরিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি মনোবল বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন আদর্শিক শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে, যাতে রোহিঙ্গারা তাদের সংগ্রামের নৈতিকতা ও লক্ষ্য সম্পর্কে আরও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়।
বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, রোহিঙ্গাদের এই সামরিক প্রস্তুতি শুধু মিয়ানমার নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তার জন্য নতুন হুমকি হয়ে উঠতে পারে। বিশেষ করে, যদি এই গোষ্ঠীর সঙ্গে আন্তর্জাতিক কোনো শক্তি বা সশস্ত্র দল যুক্ত হয়, তাহলে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা সংকট নতুন মোড় নিচ্ছে। অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়া এই জনগোষ্ঠী এখন শুধুই শরণার্থী নয়, বরং নিজেদের স্বাধীনতার জন্য লড়াইরত এক নতুন শক্তিতে পরিণত হচ্ছে। এটি সামগ্রিকভাবে আঞ্চলিক রাজনীতিতে কী প্রভাব ফেলবে, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।