অভি পাল
শিশুটি তখন গভীর ঘুমে ছিল। মায়ের বুকই তো ছিল তার পৃথিবী, যেখানে সে নিশ্চিন্ত ছিল, নিরাপদ ছিল। তিন মাস বয়সী জাওয়াদ জানত না, এই পৃথিবীতে ভয় বলে কিছু আছে। জানত না, মৃত্যু কী, আতঙ্ক কাকে বলে। কিন্তু ভাগ্য তাকে সময় দিল না, এই নিষ্ঠুর পৃথিবীকে বোঝার সুযোগ দিল না।
হঠাৎ এক প্রচণ্ড শব্দ, যেন চারপাশ কেঁপে উঠল। খজিমা বেগম ভয়ে জেগে উঠলেন। চোখ খুলেই দেখলেন, তাদের ছোট্ট ঘরটি ধসে পড়ছে, চারদিকে ধুলা আর ধ্বংসস্তূপ। বিশাল এক হাতি শুঁড় দিয়ে টিনের চাল উপড়ে ফেলছে, কাঠের পিলার ভেঙে দিচ্ছে। মৃত্যুর বিভীষিকা যেন তাদের ঘরের ভেতর ঢুকে পড়েছে।
খজিমা বেগম শিশুটিকে আঁকড়ে ধরে ছুটলেন, কিন্তু যাবেন কোথায়? চারদিকে ধ্বংসস্তূপ, ঘর থেকে বের হওয়ার পথ নেই। আর তখনই সেই ভয়ঙ্কর মুহূর্ত এল—এক বিশাল শুঁড় এসে আছড়ে পড়ল তাদের দিকে। মুহূর্তের মধ্যে শিশু জাওয়াদ তার মায়ের হাত থেকে ছিটকে মাটিতে পড়ে গেল। একটা ছোট্ট দেহ নিথর হয়ে গেল, আর কোনো নড়াচড়া নেই, আর কোনো কান্নার শব্দ নেই।
খজিমা বেগম হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন। কিছুই করতে পারলেন না, কিছু বলতেও পারলেন না। তার চোখের সামনে তার সন্তান নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে, অথচ সে কিছুই করতে পারছে না! বুক চিড়ে বেরিয়ে আসতে চাওয়া সেই চিৎকার, সেই কান্না যেন শব্দ হারিয়ে ফেলল। মৃত্যু কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে, তা এই রাতের অন্ধকারে এক মা টের পেলেন।
এ মৃত্যু কি স্বাভাবিক? এ শোক কি কেবল এই পরিবারটির? না, এটি আমাদের ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। কর্ণফুলীর কেপিজেড এলাকার হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন এই আতঙ্ক নিয়ে বেঁচে থাকে। তারা কাজে যায়, রাতে ঘরে ফেরে, কিন্তু জানে না, কখন মৃত্যুর ভয়ংকর থাবা তাদের ঘরে চলে আসবে।
আমরা জানি, এই অঞ্চল দিয়ে বন্য হাতির যাতায়াত আছে। আমরা জানি, প্রতিনিয়ত মানুষ আর হাতির সংঘর্ষ বাড়ছে। তবুও কেন এই সমস্যার সমাধান করা হচ্ছে না? কেন বন অধিদপ্তর এখনো কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি? কেন প্রশাসন শুধু মৃত্যু দেখেই নড়েচড়ে বসে?
মানুষের বসতি বেড়েছে, বন নষ্ট হয়েছে, হাতির খাদ্যের অভাব হয়েছে। কিন্তু তাই বলে কি মানুষ এভাবে মরবে? সরকার কি শুধু নীরব দর্শক হয়ে বসে থাকবে? একটি প্রাণ গেল, প্রশাসন হয়তো কিছুদিন নড়েচড়ে বসবে, কিছু আশ্বাস দেবে, কিন্তু তারপর? তারপর আবার কেউ মরবে, আবার একটি পরিবার ধ্বংস হবে।
এভাবেই কি চলবে? কত প্রাণ গেলে, কত মায়ের বুক খালি হলে, কত পরিবার ধ্বংস হলে আমরা বুঝব, ব্যবস্থা নেওয়া দরকার? মৃত্যুর এই নিষ্ঠুর গল্পগুলো বন্ধ করার দায়িত্ব কার? প্রশাসন, বন বিভাগ, জনপ্রতিনিধি—সবাই কি শুধু সংবাদ শিরোনাম দেখেই দায়িত্ব শেষ করবে?
আজ আমরা যদি চুপ থাকি, কাল হয়তো আরেকটি শিশুর মৃত্যু দেখতে হবে। হয়তো আরেকটি মায়ের বুক খালি হবে। আমরা কি সেই দিনের অপেক্ষায় আছি? নাকি এখনই ব্যবস্থা নেব?