
সাংবাদিক অভি পাল(লেখক)
গত সোমবার, ১৭ই ফেব্রুয়ারি। রাতের অন্ধকার তখন ঘনিয়ে এসেছে, শহর থেকে( ঢাকা- রাজশাহী) গ্রামের পথে ছুটছিল যাত্রীবোঝাই একটি বাস। ক্লান্ত পথিকদের ঘুম জড়ানো চোখে বাড়ি ফেরার স্বপ্ন, ভালোবাসায় মোড়ানো সনাতনী এক দম্পতির হাসি—সব কিছুই ছিল স্বাভাবিক, যতক্ষণ না সেই দানবেরা বাস থামায়।
একদল ডাকাত প্রবল দাপটে উঠে আসে বাসে। প্রথমে লুটপাট, যাত্রীদের গা থেকে গয়না টেনে নেয়, মানিব্যাগ, মোবাইল কেড়ে নেয়। কিন্তু এতেই তাদের মন ভরেনি। তাদের চোখ খুঁজছিল শিকার, এবং তারা খুঁজে পেল সে সনাতনী নারীকে।
তার স্বামী পাশে বসে ছিলেন, আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। স্ত্রীকে বুকের কাছে টেনে নিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ওরা চুলের মুঠি ধরে টেনে নিয়ে গেল। বাস ভর্তি মানুষ—কেউ কিছু করতে পারল না! যারা প্রতিবাদ করল, তাদের মুখে সজোরে ঘুষি বসিয়ে দেওয়া হলো, ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়া হলো সিটের নিচে।
নারীটি প্রাণপণে লড়তে চেয়েছিল, চিৎকার করেছিল। সে জানত, বাসে আরও অনেক মানুষ আছে, কেউ তো এগিয়ে আসবে! কিন্তু না—সবাই তাকিয়ে থাকল, কেউ মুখ খুলল না, কেউ হাত বাড়াল না। একজন বৃদ্ধ কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলেছিল, “ওদের ছেড়ে দাও, বাবা, এ অন্যায় করো না…” কিন্তু উত্তর এসেছিল লাথি দিয়ে, মুখে রক্ত জমে গিয়েছিল বৃদ্ধের।
আরেকপাশে বসেছিল এক মুসলিম মেয়ে। তাকেও ওরা দেখল, কিন্তু তার গায়ে হাত দিল না। তার ব্যাগের টাকা, গলার চেইন নিয়ে নিল, কিন্তু তাকে ধর্ষণ করল না। মেয়েটি তাকিয়ে দেখল পাশের নারীর আর্তনাদ, তার ছটফটানি, তার ভেঙে যাওয়া আত্মা—তবু কিছু করতে পারল না।
যখন পাশের সিটে পড়ে থাকা স্বামী উঠে গিয়ে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরল, তখন সে আর মানুষ ছিল না—সে যেন জীবন্ত লাশ হয়ে গিয়েছিল।স্ত্রীর কপালে হাত রেখে বলছিল, “আমি বেঁচে থেকে কী করব?” মেয়েটির দুচোখের শুকিয়ে যাওয়া অশ্রু যেন প্রশ্ন করছিল, “তোমরা সবাই কীভাবে মানুষ হয়ে বেঁচে আছো?”
বাস আবার চলতে শুরু করল, জীবনও চলবে, সমাজও চলবে। এই ঘটনার খবর হয়তো কাগজের পাতায় ছাপা হবে, হয়তো কয়েকদিন আলোচনা হবে, তারপর সব চুপ। কিন্তু সেই নারী? সে কি আবার আগের মতো বাঁচতে পারবে? সেই স্বামী? সে কি স্ত্রীকে চোখে চোখ রেখে ডাকতে পারবে? আর আমরা? আমরা কি নিজেদের আয়নায় দেখে মানুষ বলতে পারব?
কতদিন আর নীরব সমাজের বোবা দর্শক হয়ে থাকব? আজ চুপ থাকলে কাল হয়তো আমাদের প্রিয়জনের আর্তনাদও বাতাসে মিলিয়ে যাবে—তখন কী করব?