লিখেছেন: মো. আশিক চৌধুরী
বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরে এক নীরব অথচ গভীর সংকট ঘনিয়ে এসেছে। প্রতিদিন দেখা যাচ্ছে—অনেক কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে বিনা নোটিশে চাকরি থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে। কোনো কারণ, কোনো ব্যাখ্যা, এমনকি কোনো অনুশোচনাও নেই। শুধু বলা হচ্ছে, “আপনার প্রয়োজন নেই।” যাদের হাতে গড়ে উঠেছে প্রতিষ্ঠান, বছরের পর বছর যারা মেধা, শ্রম আর সময় দিয়ে ব্যাংককে এগিয়ে নিয়ে গেছেন—আজ তারাই অপ্রয়োজনীয়?
ব্যাংকের চাকরি একসময় ছিল ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা। এই চাকরির উপর নির্ভর করে গড়ে উঠত সংসার, সন্তানদের স্বপ্ন, বৃদ্ধ মা-বাবার আশা। অথচ এখন, হঠাৎ একদিন অফিসে গিয়ে শুনতে হয়—আপনার দরকার নেই। যেন মানুষ নয়, এক টুকরো কাগজ, যেটা ব্যবহার শেষে ছিঁড়ে ফেলে দেওয়া যায়।
এই ঘটনাগুলো শুধু চাকরি হারানোর বিষয় নয়। এটি একজন মানুষের আত্মসম্মানের উপরে বড় এক আঘাত। ঘরে ফেরার পর পরিবারের চোখে তাকানো যায় না। সন্তানকে বই কিনে দিতে পারা, বাসার ভাড়া মেটানো, নিত্যপ্রয়োজন মেটানো—সবকিছু যেন একসাথে চাপ ফেলে বুকের ওপর। অথচ সেই মানুষটি কোনো ভুল করেননি। কোনো ব্যর্থতায় ভুগছিলেন না। শুধু কোম্পানির সিদ্ধান্ত—”তাকে আর দরকার নেই।”
বলা হচ্ছে ব্যয় সংকোচন চলছে। প্রতিষ্ঠান আর আগের মতো লাভবান নয়। কিন্তু আমরা দেখি, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা আগের মতোই বিলাসবহুল জীবন যাপন করছেন। বিদেশ সফর, বাড়তি বোনাস, গাড়ি, নতুন অফিস—সব কিছু ঠিক আছে। তাহলে ছাঁটাইয়ের বোঝা কেবল নিচের দিকের কর্মচারীর ঘাড়ে কেন?
এইভাবে চলতে থাকলে দেশের সব বেসরকারি চাকরি আজ হুমকির মুখে পড়বে। কেউ আর নিশ্চিতভাবে বলতে পারবে না, “আমি একটি স্থায়ী চাকরিতে আছি।” পরিবারগুলো সারাক্ষণ ভয়ে থাকবে—আজ না হয় কাল চাকরি যাবে। এমন অনিশ্চয়তা দিয়ে কি একটি সমাজ চলে?
ব্যাংকের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ খাতে এমন হঠাৎ ছাঁটাই শুধু অবিচার নয়, এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক বিপর্যয়ের সূচনা। এই অবস্থার পরিবর্তন দরকার। কেবল নীরব থেকে এই অন্যায় থামানো যাবে না। দরকার সম্মিলিত প্রতিবাদ, সাহসী কণ্ঠ, আর ন্যায়বিচারের দাবি।
মানুষ কোনো যন্ত্র নয়, যাকে দরকার মতো চালু করে, দরকার শেষে ফেলে রাখা যায়। মানুষই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে, মানুষই অর্থনীতিকে সচল রাখে। সেই মানুষকে মর্যাদা না দিলে, লাভে গড়া ব্যাংকও একদিন খালি হয়ে যাবে—ভিতরে থাকবে শুধু বোবা দেয়াল আর ঠান্ডা টেবিল।