“লালদিঘী: এক জলাশয়, এক  ভয়ং*কর বিপ্লবী অতীতের সাক্ষী!”

অভি পাল(লেখক)

কল্পনা করুন, শহরের কোলাহলময় জীবন থেকে এক পা বেরিয়ে এসে আপনি দাঁড়িয়ে আছেন এক বিস্তীর্ণ জলাশয়ের সামনে। স্নিগ্ধ  বাতাস গায়ে এসে লাগে, সামনে দিঘীর স্বচ্ছ জলে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হচ্ছে, আর পাখির কিচিরমিচির শব্দে চারপাশ ভরে উঠছে। যেন শত ব্যস্ততার মাঝেও প্রকৃতি আপনাকে ডেকে নিচ্ছে তার প্রশান্তির কোলে। এই অপার সৌন্দর্যের নাম লালদিঘী, চট্টগ্রামের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সৌন্দর্যের এক চিরন্তন প্রতীক।

লালদিঘী শুধু একটি জলাশয় নয়, এটি চট্টগ্রামের অতীত ও বর্তমানের সেতুবন্ধন। এই দিঘীর চারপাশে গড়ে উঠেছে অসংখ্য গল্প, লড়াই, সংগ্রাম আর পরিবর্তনের কাহিনি। ব্রিটিশ আমলে এটি ছিল শহরের অন্যতম প্রধান জলাধার, যা নগরবাসীর পানির চাহিদা পূরণ করত। তবে সময়ের প্রবাহে এটি শুধুমাত্র জলাশয় নয়, এক স্মৃতিসৌধে পরিণত হয়েছে। একসময় এই দিঘীর পাড়েই ঘটেছিল ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো। শতাব্দী পেরিয়ে এলেও সেই অতীতের পদচিহ্ন আজও রয়ে গেছে লালদিঘীর পরিবেশে, এর বাতাসে, এর প্রতিটি ঢেউয়ে।

লালদিঘীর ইতিহাস আরও গভীরে গেলে দেখা যায়, এটি মুঘল আমল থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। ১৭৬১ সালে মীর কাসিম বাংলার নবাব হওয়ার পর ব্রিটিশদের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। তখন তিনি ব্রিটিশদের প্রতিরোধ করতে চট্টগ্রামের এই অঞ্চলে দুর্গ নির্মাণ করেন, যার পাশে ছিল এই দিঘী। তখন থেকেই লালদিঘী একটি কৌশলগত স্থান হিসেবে পরিচিতি পায়। পরবর্তীতে ব্রিটিশ শাসনামলে এই দিঘীর পাড়ে রাজনৈতিক সভা ও প্রতিবাদ আন্দোলন সংঘটিত হয়। ১৯৩০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর মাসে বিপ্লবী সূর্যসেনের নেতৃত্বে যুব বিদ্রোহীরা লালদিঘীর পাড়েই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন।

শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত হওয়া সত্ত্বেও লালদিঘী এক অনন্য শান্তির নীড়। প্রতিদিন ভোরবেলা এখানে দেখা মেলে প্রকৃতিপ্রেমীদের, যারা নির্জন পরিবেশে কিছুটা সময় কাটাতে আসেন। ধীরে ধীরে শহরের কর্মব্যস্ততা শুরু হয়, কিন্তু লালদিঘীর সৌন্দর্য যেন অনড়। বেলা বাড়ার সাথে সাথে এখানকার পরিবেশও বদলে যায়। দুপুরে চারপাশের ভবনগুলোর প্রতিচ্ছবি যখন দিঘীর জলে ভেসে ওঠে, তখন এটি হয়ে ওঠে এক স্বচ্ছ আয়নার মতো।

কিন্তু লালদিঘীর সবচেয়ে মোহনীয় রূপ দেখা যায় বিকেলবেলায়। যখন সূর্যের শেষ আলো দিঘীর জলে পড়ে, তখন স্বর্ণালী আভায় মিশে যায় প্রকৃতি আর সময়। এই সময়টাতে লালদিঘীর পাড়ে বসে থাকা মানুষগুলোর মুখে দেখা যায় প্রশান্তির ছাপ। কেউ চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আড্ডায় মেতে ওঠেন, কেউবা একলা বসে প্রকৃতির সৌন্দর্যে হারিয়ে যান। হাঁটতে হাঁটতে, গল্প করতে করতে তারা যেন ভুলে যান নগর জীবনের ব্যস্ততা।

লালদিঘীর চারপাশে ছড়িয়ে আছে পুরনো চায়ের দোকান, যেখানে পাওয়া যায় চট্টগ্রামের বিখ্যাত দুধ-চা, মশলাদার সিঙ্গারা আর বাহারি খাবার। এটি শুধু চট্টগ্রামের মানুষের অবসর কাটানোর স্থান নয়, বরং এক মিলনমেলা। এখানে যেমন সাধারণ পথচারী আসেন, তেমনি আসেন পর্যটকরা, যারা চট্টগ্রামের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির স্বাদ নিতে চান।

লালদিঘী শুধুই এক জলাশয় নয়, এটি এক আবেগ, এক স্মৃতি, এক ঐতিহ্যের ধারক। এটি প্রমাণ করে, সময় বদলায়, শহর আধুনিক হয়, কিন্তু প্রকৃতি আর ইতিহাস কখনও হারিয়ে যায় না। চট্টগ্রামের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা লালদিঘী আজও সাক্ষ্য দেয় শহরের গৌরবোজ্জ্বল অতীতের, শহরের অপরূপ সৌন্দর্যের, আর চট্টগ্রামের মানুষদের চিরন্তন প্রাণচাঞ্চল্যের। এই দিঘী শুধু পানি ধরে রাখে না, ধরে রাখে এক নগরীর আত্মা।